স্বপ্নডিঙ্গা

 তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধে অদ্রিতার নাক বন্ধ হয়ে আসছে। প্রস্রাবের গন্ধ  এত বেশরমভাবে তার নাকে ঢাক্কা দিচ্ছে যে যেকোন সময় বমির সমূহ সম্ভাবনা নাকচ করা যাচ্ছে না। স্কুলের পিচ্চিগুলার উপর হঠাৎ করে ভীষণ রাগ হয় তার। বাসায় নিশ্চয় বাচ্চাগুলা এভাবেই টয়লেটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে প্রাকৃতিক কর্ম সারে। 

 “তুমি প্রতিদিন টয়লেটে কি কর?”।

বাচ্চাটার কথায় সে চমকে যায়। ঘড়িতে এখন ১২.২১ মিনিট। আর কতক্ষণ পরেই ছুটি। ছুটি হলেই শান্তি। অদ্রিতা আশপাশে তাকিয়ে দেখে বেলায়েত আছে কিনা। ড্রাইভারটা একটু মাথা মোটা হলেও ওর ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখার নির্দেশ রয়েছে। কোন ভুল করা যাবে না। যদিও এটা তার প্রথম চেষ্টা নয়। মাথার স্কার্ফটা সে টেনে আরেকটু সামনে নামায়। পাশ থেকে দেখে চেনার উপায় নেই। গরমে মাথা ভিজে ছুপছুপে হয়ে গেছে। সে দরদর করে ঘামতে থাকে গরমে।  প্রিন্সিপাল মাহমুদা সুলতানা ম্যাডামকে করিডোরে দেখে সে আড়ালে সরে আসে। অবিসংবাদী বজ্রকন্ঠীতার জন্য অনেকের কাছে তিনি হিটলার ম্যাডাম  নামেও পরিচিত। আড়ালে অনেকেই তার বিরুদ্ধে অনেক কিছু বলে। যদিও তার সামনে গেলে সবাই ভেজা বেড়াল হয়ে যায়। হিটলারের সাফল্যের গোপন রহস্য বোধহয় এখানেই। সবাই তাকে সমীহ করে। 

ছুটির ঘন্টা হঠাৎ বেজে ওঠে। যাক বাঁচা গেল। আর মিনিট দুয়েক পরে তার মুক্তি।  রাফির মুখটা তার চোখে ভেসে ওঠে।  শান্ত কিন্তু স্থিরচিত্ত, লাজুক কিন্তু বলিষ্ঠ। প্রথম দেখাতে তাকে গোবেচারা বলে অনেকে ভুল করে। ওর বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, স্মিত হাসির আড়ালে লুকিয়ে আছে সহজ-সরল, নিষ্পাপ মন। অদ্রিতার মা-বাবা যখন টিচার বদলাতে-বদলাতে পরিশ্রান্ত, দিশেহারা তখনই রাফির আগমন। প্রথম দেখাতে ওর মা বিশেষ করে ওর বাবা পাত্তাই দিয়ে চায়নি। ছিপছিপে হাল্কা-পাতলা গড়ন,  পরে যখন শুনলো যে ও বুয়েটের ছাত্র তখন তারা একটু নড়েচড়ে বসেন। যাক এতদিনে বোধহয় একটু আশার আলো দেখা গেল। কথায় কথায় তারা জানতে পারেন রাফির বাবা ও যখন ক্লাস সেভেনে পড়ে তখনই মারা যায়। এরপর থেকে সে একমাত্র তার ইচ্ছাশক্তির জোরেই এতদূর এসেছে। তারা যে তাকে টিচার হিসেবে রেখে ভুল করেননি তার প্রমাণ মিলল টেস্ট পরীক্ষার ফলাফলে। যেখানে অদ্রিতা কোনদিন ৬০ এর বেশি মার্কস পায়নি সেখানে টেস্টে তার মার্কস ৮৩। 

 বাচ্চারা ছোটাছুটি শুরু করেছে। বাচ্চাদের প্রথম দল যাওয়ার পর তৃতীয় দলের সাথে সে অভিভাবক হিসেবে খোঁড়াতে খোঁড়াতে মিশে যায়। জানালায় দাঁড়িয়ে লুকিয়ে কথা বলতে বলতে তার পায়ে ঘা হয়ে গেছে। মাঝে তো একদিন বেসিনের উপর দাঁড়িয়ে কথা বলতে গিয়ে বেসিনই ভেঙ্গে ফেলেছিল সে। সাতদিন ধরে বিছানায় ভাংগা পা নিয়ে ছিল সে। 

“ বাবু আমাকে তোমার ব্যাগ দিবা? ব্যাগের খুব ওজন না?  ”, অদ্রিতা অনুনয়ের সুরে কথা বলতে থাকে। “ আমি তোমাকে গাড়িতে উঠিয়ে দেই? ”। 

বাচ্চাটা কিছু বোঝার আগেই ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে সে রাস্তার ওপারে বাচ্চাটার মায়ের কাছে ব্যাগটা তুলে দেয়। বেলায়েত পান খেতে ব্যস্ত। এভাবে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে টয়লেটে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে গোপনে দেখা করে আরো কতদিন যে তার কাটাতে হবে ওপরওয়ালাই জানে। রাফির কথা মনে হতেই অদ্রিতার চোখে পানি চলে আসে। আসার আগে বাসার ফ্রিজ মোটামুটি সে খালি করে এসেছে। পায়েস, মিষ্টি, দৈ, বেদানা, কামরাঙ্গা, বেলের ভারে সে অনেকটা কুঁজো। বেচারা কয়েক মাস ধরে ওর টিউশনি নেই। সকাল থেকে নিশ্চয় না খেয়েই আছে। একথা মনে হতেই সে আরো জোরে হাঁটতে থাকে।

২.

“ কিরে দোস্ত ক্লাসে যাবিনা? ”, সুজন জিজ্ঞেস করে।

“ না ”, রাফি উত্তর দেয় ।

“ কিরে তোর ডার্লিং আসতাছে নাকি রে? ” । 

রাফির হ্যাঁ-সূচক মাথা ঝাঁকানি দেখে সে বুঝে নেয়।

“তোরাই সুখে আছস। হায় রে পোড়া কপাল! জীবনে প্রেম করতে পারলাম না।  দুক্কু......দুক্কু”।

 দারোয়ান এসে খবর দেয় দুজন গেস্ট রাফির সাথে দেখা করতে চায়। ঝটপট তৈরি হতে থাকে রাফি। 

 “এই রাফি আনকমন কোন খাবার-টাবার থাকলে ডাক দিস। আহা রে! বাড়ির খাবার কতদিন খাই না......। দুক্কু......দুক্কু ”, সুজন আফসোস করতে থাকে। কথায় কথায় দুক্কু-দুক্কু বলা ওর অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। 

 গেস্ট রুমে গিয়ে রাফি দেখে অদ্রিতার বাবা-মা দুজনেই এসেছেন। হঠাৎ তাদের আগমনের হেতু সে বুঝে উঠতে পারে না। 

 “আঙ্কেল হঠাৎ আমার হলে? আপনারা এত কষ্ট করে এসেছেন। আমি তো বিকেলেই আপনার বাসায় যেতাম”, রাফি বলল।

“ তোমার আর অদ্রিতাকে পড়ানোর দরকার নেই”, হাবিব সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন। “আজ থেকে তোমার আর আমাদের বাসায় যাওয়ার দরকার নেই। বামন হয়ে আকাশে হাত বাড়ানো ঠিক না” । 

মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে তার কথাগুলো ভেসে আসছে। রাফির মনে হল তার পায়ের নিচে মাটি নেই। সে শুন্যে ভেসে আছে। শরীরটা হঠাৎ হাল্কা মনে হচ্ছে। যেকোন সময় দমকা হাওয়ায় সে উড়ে যেতে পারে। পাখি কি আকাশে ওড়ার সময় কথা বলে? কে জানে!! তবে সে এমুহূর্তে কথা বলতে পারছে না। হাবিব সাহেব আরো কি কি যেন বললেন। কিন্তু তার কিছুই তার মাথায় ঢুকল না। শুধু অদ্রিতার হাসি তার চোখে ভাসতে থাকে।

৩.০

 “আঙ্কেল আমার পকেটমার হয়েছে। ভাড়াটা দিতে পারছি না। একটু কাইন্ডলি কি আমার ভাড়াটা দিবেন?”, অদ্রিতা করুণ কন্ঠে অনুনয় করতে থাকে। 

ভদ্রলোক অদ্রিতার দিকে তাকায়। বেশ-ভূষায় সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে বলেই মনে হচ্ছে। 

“কোত্থেকে আসছো তুমি?”, ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করেন।

“এইতো বেইলী রোড থেকে পলাশী পর্য্যন্ত”, উত্তর দেয় অদ্রিতা।

“সরি আমি তোমাকে হেল্প করতে পারছি না”, ভদ্রলোক হাঁটা ধরেন। বোঝা যাচ্ছে ভদ্রলোক ঢেঁকি গিলবেন না।

অদ্রিতা নিরাশ হয় না। এটা নতুন না। আজ একটু বেশি কষ্ট করতে হবে ঢেঁকির জন্য!

“আন্টি! আন্টি! একটু কাইন্ডলি হেল্প করবেন?” অদ্রিতা কান্নাজড়িত গলায় বলে, “ কাকরাইল মোড়ে আমার ব্যাগ ছিনতাই হয়েছে। আমি এখন বাসায় যেতে পারছি না। আন্টি”।

আন্টির নিশ্চয়ই মেয়ে আছেন। কারণ বলার সাথে সাথে উনি মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিলেন। যাক বাঁচা গেল! 

কয়েকদিন ধরে ওর বাবা  হাত-খরচ আগের মতন দিচ্ছে না। খুব সম্ভবত ঈপ্সিতা গোপণ পরিণয়ের কথা বাসায় বলে দিয়েছে। ঈপ্সিতা ওর বড় বোন। মাত্র দেড় বছরের বড় হওয়ায় তার সাথে তুই-তোকারি সম্পর্ক। ঈপ্সিতার এই কাজটা ঠিক হয়নি। দুজনেই একসাথে প্রেম শুরু করেছিল। কিন্তু ঈপ্সিতার প্রেম বেশিদূর এগোয়নি। হাত-খরচের সাথে প্রেমের সম্পর্ক বোধহয় ব্যস্তানুপাতিক। প্রেম বাড়লে হাত-খরচ কমে, প্রেম কমলে হাত-খরচ বাড়ে। বাবা কখনো এরকম করেনি।

 ঢাকা মেডিকেলে রোগীর ভিড় সারা বছর লেগেই আছে। সরকারী হাসপাতালে কখনো যায়নি অদ্রিতা। যাওয়ার প্রয়োজনও পড়েনি। এপোলো, স্কয়ার,ইউনিক ছাড়া অন্য কোন হসপিটালের কথা সে চিন্তাই করতে পারেনা। একমাত্র রাফির সাথে দেখা করার জন্য তাকে ঢাকা মেডিকেল চিনতে হয়েছে। সরকারী হাসপাতালে অব্যবস্থাপনার সহজ নমুনা হচ্ছে টয়লেট। চরম দূর্গন্ধ, ওষুধের কটূ গন্ধ, মাছির ভনভনানি আর মশক মহাশয়ের সরব উপস্থিতি। 

 সে সোজা মহিলা টয়লেটে চলে যায়। তার মধ্যে বুনো উত্তেজনা কাজ করছে। রাফির সাথে দেখা করতে এলেই তার এমন হয়। ব্যাগ খুলে সে মেক-আপ বক্স বের করে। আজ তাকে পরীর মত করে সেজে বের হতে হবে।

 “আপা আপনি টয়লেটের ভিতরে মেক-আপ বক্স নিয়ে কি করেন?”, এক কিশোরী জিজ্ঞেস করে।

অদ্রিতা চমকে যায় কিন্তু কোন উত্তর দেয়না। সে সাঁজতে থাকে তার, শুধু তার রাফির জন্য। 

  


Comments

Popular Posts